বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৬ অপরাহ্ন
বাংলা ট্রিবিউন : ‘তারা আমাদের জন্য জাল বিছায়, তারা হয়তো বা খাবারের ব্যবস্থা করে, হয়তো বা ওষুধ দেয়, সবই দেয়—এতে কেউই আশা করে না যে, তারা মানুষকে গ্রেফতার করবে। তারা (প্রবাসীরা) খুনি নয়, তারা অপরাধী নয়, তারা শুধুমাত্র কাগজপত্রহীন!’—আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথাগুলো বলেছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ২৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি রায়হান কবির। ওই সাক্ষাৎকারে নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরাই কাল হয়েছে তার জন্য। এরপর মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ তাকে হন্য হয়ে খোঁজার পর না পেয়ে বাতিল করেছে তার ওয়ার্ক পারমিট। শুধু রায়হানই নয়, মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন জেলে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন আরও অনেক বাংলাদেশি। ভুক্তভোগীদের মতে, সেখানে কেবল বাংলাদেশিদের ভাগ্যেই জোটে এমন নির্যাতন।
নির্যাতনের শুরুটা হয় যেভাবে
মালয়েশিয়ায় গ্রেফতারের পর চার ঘণ্টা এক জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল পিরোজপুরের সোহেলকে। তার অপরাধ, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি সেদেশে অবস্থান করছেন। সোহেলের ভাষ্যমতে, ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে ৪-৫ মিনিট পর পর একেকজন আসে, তারা লাঠি দিয়ে পেটায়। এরপর বুকিত জলিল ইমিগ্রেশন ক্যাম্পের সামনে রাস্তায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কড়া রোদের মধ্যে বসিয়ে রাখে। কড়া রোদের মধ্যে গরমে অনেক সময় হাত পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। এভাবে বসিয়ে রাখার পর ক্যাম্পের ভেতরে ৬০০ লোকের সঙ্গে একটি ব্লকে জায়গা হয় তার। ক্যাম্পের ওই ব্লকে ধারণক্ষমতা মাত্র ১০০ জনের হলেও সেখানে ৬০০ জনের মতো বন্দি ছিলেন বলে জানান সোহেল।
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে ঢোকানোর আগে সবাইকে জামাকাপড় খুলে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তারপর কান ধরিয়ে উঠবস করাবে হাজারখানেক বার। উঠবস করতে করতে যিনি পড়ে যান, তাকে পেছন থেকে মারে। মোটা লাঠি আছে ওটা দিয়ে মারে। একজনকে ইচ্ছেমতো মারে, বাকিরা ওই মার দেখে সোজা হয়ে যায়। এরপর সবাইকে একটা রিমান্ড রুমে রাখে। সেখানে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। ওই রুমেই খাবার, ওখানেই গোসল, ওখানেই ঘুম। একটা রুমে একসঙ্গে অনেকজন থাকে।’ সোহেল বলেন, ‘আমার রুমে আমরা ২৪ জন ছিলাম, যদিও ওই রুমের ধারণক্ষমতা ১০ জনের। এরপর আমাকে একদিন কোর্টে ওঠানো হয়। সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোর্টে নিজের কথা বলার কোনও সুযোগ নেই। তারা যেটা বলে সেটাই। কোর্টে একসঙ্গে অনেক দেশের মানুষকেই হাজির করে। সেসময় ইমিগ্রেশন অফিসাররা চলে যায়, আসে পুলিশ। পুলিশ এসে সবার পকেট চেক করে। মোবাইল, টাকা-পয়সা যা পায়, নিয়ে যায়। যদি কেউ দিতে না চায়, তাহলে তাকে মারধর করা হয়।’
একেক জায়গায় নির্যাতনের ধরন একেক রকম
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকে শুরু করে একেক জায়গায় একেক ধরনের নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে, ইমিগ্রেশন ক্যাম্পের বাইরে এক ধরনের মারধর,আর ক্যাম্পের ভেতরে আরেক ধরনের মারধর করা হয়। ক্যাম্পের বাইরে মাথা এবং পায়ের তলায় মারা হয়। ক্যাম্পের ভেতরে শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় বেত দিয়ে মারা হয়। রাতে কেউ যেন ঘুমাতে না পারে, সেজন্য পানি দিয়ে বিছানা ভিজিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে একটা কম্বল দুই জনে ব্যবহার করে, সেটাও ভিজিয়ে দেয়। সারাদিন কাপড় ভিজে থাকে, সেগুলো পরে তো আর ঘুমানো যায় না।
মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে সাত মাস কাটিয়ে আসা আল আমিনের মতে, মালয়েশিয়ার জেলে নির্যাতনের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ জেল মালয়েশিয়ার। অনেক মানুষ না খেয়েও মারা যায় ওই জেলে। খাবারের কষ্ট দেওয়া ছাড়াও তাদের ‘সম্মান’ দেওয়ার জন্য রয়েছে একঘণ্টা ‘মাস্টার টাইম’। এই সময়ে তাদের সামনে বসে থাকা লাগে। তাদের সম্মান করতে করতে আমাদের জীবন শেষ। এমনিতে তো শারীরিক নির্যাতন আছেই। তারা মারার জন্য লোহার পাইপ ব্যবহার করে।’’
মুক্তি পেতে দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়
মালয়েশিয়ার ক্যাম্প থেকে বের হয়ে দেশে আসার জন্য খরচ করতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। আর এজন্য সক্রিয় আছে দালালচক্র। দালালের মাধ্যমে দেশে ফোন করে টাকা আনিয়ে সেখান থেকে মুক্তি পেতে হয়। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। তবে সেই কাজে তারা নিয়োগ দেয় স্থানীয় দালালদের। ফোনে কথা বলিয়ে দেওয়ার আগে দুই হাজার টাকা রিচার্জ করিয়ে নেয় ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে। এরপর ফোনে কথা বলিয়ে দেয় দালাল। পরিবারের কাছ থেকে টিকিটের অর্থ সংগ্রহ করার কাজ করে দালালরা। আর এই অর্থের পরিমাণ টিকিটের মূল্যের দ্বিগুণ।
মালয়েশিয়া থেকে আসা আল আমিন বলেন, ‘টিকিটের টাকা পরিবার যদি না পাঠাতো, আমি মইরা গেলেও ওরা আমার লাশ দেশে পাঠাতো না। টিকিটের টাকা বেশি না দিয়ে আমার উপায় ছিল না, আমি তো মরার অবস্থায় ছিলাম। আল্লাহ আমাকে বাঁচায়ে এনেছে, টাকা তো বড় কথা না। টিকিটের খরচ ছিল ৪০ হাজার টাকা। ওইখানে দালাল আছে সেই সব করে দেয়। আমার পরিচিত কোনও দালাল ছিল না। আমার দুলাভাই এক লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে দালাল ধরে আমাকে আনার ব্যবস্থা করছে।’
সোহেলও জানান একই কথা। তিনি বলেন, ‘যাদের সেখানে পরিচিত কেউ আছে, তাদের মাধ্যমে আসলে সময় কম লাগে। আমার তেমন কেউ পরিচিত ছিল না বলে আসতে দেরি হয়েছে। ইমিগ্রেশনে টাকা দিলে ওরা টিকিট কেটে দেয়। কিন্তু টিকিটের দাম এক হাজার রিঙ্গিত হলে তাদের দুই হাজার রিঙ্গিত দিতে হয়। না-হলে টিকিট কেটে দেয় না। টাকা কম দিলে পাসপোর্ট ফেলে দেয়। আমার পাসপোর্ট এভাবে ফেলে দিয়েছিল। এজন্য আমার আসতে অনেকদিন দেরি হয়েছে।’
বাংলাদেশিদের ওপরই নির্যাতন বেশি
ভুক্তভোগীরা জানান, ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা থাকলেও বাংলাদেশিদের ওপর নির্যাতনের পরিমাণ অনেক বেশি। আল আমিন বলেন, ‘যারা সেখানে জেল খাটছে একমাত্র তারাই বলতে পারবে, সেখানকার পরিস্থিতি কত খারাপ। জেলে আরও দেশের নাগরিকরা আছে, কিন্তু বাংলাদেশিদের ওপরেই তাদের যত রাগ।’
মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভিযোগ— বাংলাদেশি দূতাবাস কখনোই কাগজপত্রহীন প্রবাসীদের বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেয় না। কাউকে জেলে পাঠালেও কোনও খোঁজ নেয় না। দূতাবাস আগে পদক্ষেপ নিলে জেল পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হয় না বলে মনে করেন অনেক প্রবাসী। এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাই কমিশনে রাষ্ট্রদূত এবং শ্রম কাউন্সেলরকে ফোন দেওয়া হলেও তারা রিসিভ করেননি।
আতঙ্কে আছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী প্রবাসীরা
আল জাজিরায় প্রতিবেদন সম্প্রচারের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে মালয়েশিয়ায়। আল জাজিরার ওই প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলছে মালয়েশিয়ার সরকার। সেদেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ রায়হানের ছবি প্রকাশ করে তথ্য চাওয়ায় আতঙ্ক বেড়ে যায় প্রবাসীদের মধ্যে। রায়হানের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর ঘোষণায় ভীষণ উদ্বিগ্নে আছেন প্রবাসীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুয়ালালামপুর থেকে একজন প্রবাসী বলেন, যারা কাগজপত্রহীন অবস্থায় আছেন তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন। এখন যারা কাগজপত্রসহ আছেন তারাও আতঙ্কে আছেন। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরপাকড় করলে গণহারে করে। আর রায়হানের তথ্যের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েও তারা সবাইকে হয়রানি করছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, মালয়েশিয়ার এই ঘটনা অতীতেরই পুনরাবৃত্তি। কোনোবারই প্রতিবাদ না জানানোর কারণে এমন ঘটনা এখনও ঘটছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই কিন্তু অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়া থেকে ফেরত এসেছেন। এদের অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন এবং নির্যাতনের কোনও মাত্রা নাই। এসব নির্যাতনের ঘটনার একটি প্রতিফলন দেখা গেছে আল জাজিরার প্রতিবেদনে। কিন্তু আমরা কখনও দেখিনি যে, এই ধরনের ঘটনায় আমাদের রাষ্ট্র শক্ত কোনও প্রতিবাদ করেছে। যেসব ভুক্তভোগীর কথা সামনে আসছে, আমাদের রাষ্ট্রদূত কিংবা দূতাবাসের কর্মকর্তারা কি কখনও জানতে চেয়েছেন, কেন উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়েছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘বারবার আমরা কয়েক লাখ কর্মী আছে বলে শ্রমবাজারের কথা চিন্তা করে কিছু বলি না। এগুলো ভাবতে গিয়ে আমরা সবসময় কর্মীদের ওপর নিপীড়নের কথা এড়াতে চাই। শুধু মালয়েশিয়ার এই ঘটনাই নয়, কোনও দেশের ঘটনাতেই আমরা শক্তভাবে কিছু বলতে পারি না। একটি ছেলে সাক্ষাৎকার দেওয়াতে পুরো বাংলাদেশ কমিউনিটিকে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হচ্ছে, এগুলো কিন্তু অভিবাসী সংক্রান্ত আইনের মধ্যেই পড়ে না। এই একই ইন্টারভিউতে আরও অন্য দেশের নাগরিকদের বক্তব্যও আছে। তাদের বিরুদ্ধে তো কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রায়হানের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ তাকে খুঁজছে। তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে বলে ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করেছে। তারা কেবল বাংলাদেশিদের সঙ্গেই এরকম করতে পারে। কারণ, তারা জানে যে এরকম করলে কেউ কোনও প্রতিবাদ করবে না। যার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটে। এজন্য আমি বলি, আমরা যতক্ষণ আমাদের নাগরিকদের সম্মান না দেবো, পৃথিবীর কোনও দেশ দেবে না।’
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply